রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে মন্ত্রণালয়ের ৩ নির্দেশনা
বার্তাবহ চাঁদপুর নিউজ: বিদেশে অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন বন্ধে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে তিন দফা নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এগুলো হল- কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফইউ) গাইডলাইনের আলোকে ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে, সব ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগ ও অথোরাইজড ডিলার শাখায় মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগে দক্ষ লোকবল বাড়াতে হবে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইওদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে ব্যাংকগুলোকে দ্রুত অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সর্বশেষ প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে এক হাজার ১৫১ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। দেশীয় মুদ্রায় এটা ৯৮ হাজার কোটি টাকা। দুই প্রক্রিয়ায় এই অর্থ পাচার হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) এবং রফতানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডারইনভয়েসিং)। সেখানে আরও বলা হয়, ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশ তথ্য দিলেও বাংলাদেশ ২০১৬ ও ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি। জিএফআই’র সিনিয়র ইকোনমিস্ট রিক রাউডেন জানান, অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ জাতিসংঘে তথ্য দিয়ে আসছে। কিন্তু ২০১৬ এবং ২০১৭ সালের কোনো তথ্য দেয়নি দেশটি।
জানা যায়, বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের উপায় নির্ধারণের বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে দেশ থেকে অর্থ পাচারের চ্যানেল এবং প্রতিরোধে করণীয় বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
বৈঠকে বলা হয়, টাকা পাচারের অন্যতম একটি চ্যানেল হচ্ছে ব্যাংক। এলসি খোলার মাধ্যমে তা করা হয়। আবার অর্থ পাচার প্রতিরোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ব্যাংকগুলো। বিশেষ করে গ্রাহক নির্বাচন ও গ্রাহকের ব্যবসার ধরন নির্বাচনে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে হবে।
এক্ষেত্রে ব্যাংকের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। এছাড়া ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডারইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্যিকভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি গুরুত্ব পায় সেখানে। সেখানে বলা হয়, এই কৌশলে দীর্ঘদিন ধরে অর্থ পাচার হচ্ছে।
বৈঠকে বিদেশি কর্মীদের (যারা বাংলাদেশে কাজ করছেন) দেশে অর্থ পাঠানোর বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ট্রাভেল ভিসা নিয়ে অনেক বিদেশি কর্মী দেশে প্রবেশ করছে। পরবর্তীতে ভিসার ধরন (ই-ভিসা) পরিবর্তন করে উচ্চ বেতনে চাকরি করছে। তাদের কাছ থেকে যথাসময়ে আয়কর আদায় করা যাচ্ছে না। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। বৈঠকে এ বিষয়টি নজরদারির আওতায় আনার সিদ্ধান্ত হয়।
এছাড়া ব্যাংকগুলো অর্থ পাচার প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইড) কর্তৃক প্রণীত ‘গাইডলাইন ফর প্রিভেনশন অব ট্রেড বেসড মানি লন্ডারিং বাস্তবায়নে প্রত্যেক ব্যাংকে নির্দেশ দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরে এই গাইডলাইন বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (বিডিবিএল) চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
চিঠিতে বলা হয়, অর্থ পাচার বন্ধ ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো নিজস্ব একটি গাইডলাইন প্রণয়ন করতে হবে। আর এটি ব্যাংকে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অর্থাৎ বোর্ড অব ডিরেক্টর্স কর্তৃক অনুমোদন নিতে হবে। এরপর এটি ভেটিংয়ের জন্য পাঠাতে হবে বিএফআইইউতে।
সেখানে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ বিভাগে পর্যাপ্ত লোকবল যুক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের শাখার পরিধি, কর্মবল, গ্রাহক সংখ্যা ও ব্যবসার আকার বিবেচনা রেখে এখানে জনবল পদায়ন করতে হবে। প্রয়োজনে নতুন নিয়োগের আগে বিদ্যমান জনবল হতে পদায়ন করে পর্যাপ্ত লোকবল নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ব্যাংকের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিভাগ এবং অথোরাইজড ডিলার শাখায় মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত প্রশিক্ষিত লোকবল নিশ্চিত করতে হবে।
টাকা পাচার প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, মানি লন্ডারিং ও টাকা পাচার প্রতিরোধে যে আইন হয়েছে এর বাস্তবায়ন সন্তোষজনক নয়। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে।
দেশ থেকে আগের তুলনায় অর্থ পাচার বেড়েছে। দুর্নীতিবাজরা হুন্ডির মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করছে। বিদেশে অবস্থানরত আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে টাকা পাচার করছে। তিনি আরও বলেন, মালয়েশিয়া ও কনাডায় কারা বেগমপাড়া গড়ে তুলছে, বাড়ি করেছে- দুর্নীতি দমন কমিশন অভিযান চালালেই তা বের হয়ে আসবে।
কোরিয়া, উগান্ডা, নেপালসহ বিশ্বের অনেক দেশে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা শিল্প-কারখানা গড়ে তুলছে। এখানে এফবিসিসিআইয়ের অনেক সদস্যও আছেন। এসব সন্ধান চালালে টাকা পাচারকারীদের সহজে শনাক্ত করা যাবে। সরকারকে এসব দিকে নজর দিতে হবে।